রবিবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০২১

জো বাইডেন প্রশাসন ও ফিলিস্তিন সমস্যা-

File Picture :


যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও একই সাথে সরকারপ্রধানও। দেশটির ফেডারেল সরকারের নির্বাহী শাখা চলে প্রেসিডেন্টের নির্দেশনায়। তিনি দেশের সশস্ত্রবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ। ফেডারেল সরকারের সার্বিক ক্ষমতা তারই হাতে। আমেরিকার রাজনৈতিক জীবনে তার শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিশ্ব রাজনীতিতে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। দেশটি বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি হওয়ায় এর প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় যোগ হয়েছে বাড়তি মাত্র। জিডিপি বিবেচনায় বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তার রয়েছে আলাদা মর্যাদা।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের যাবতীয় ক্ষমতা সংবিধান স্বীকৃত। সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ অনুসারে গঠিত ফেডারেল সরকারের নির্বাহী ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে। এসব ক্ষমতার মধ্যে আছে : ফেডারেল আইন কার্যকর ও প্রয়োগ করা, ফেডারেল সরকারের নির্বাহী কর্মকর্তা, কূটনীতিক ও নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তাদের নিয়োগদান। সংবিধানের প্রবিধান মতে, প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা রাখেন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ ও গ্রহণসহ বিদেশের সাথে চুক্তি করা, কংগ্রেসে আইন পাস করার ইত্যাদি। আধুনিক যুগের মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রাথমিক দায়িত্ব বিদেশনীতি পরিচালনা। তিনি ক্ষমতা রাখেন বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সামরিক বাহিনী পরিচালনার, যার রয়েছে দ্বিতীয় বৃহত্তম ‘নিউক্লিয়ার আরসেনাল’। তিনি ক্ষমতা রাখেন ফেডারেল আইনে স্বাক্ষর কিংবা ভেটো প্রয়োগের। তিনি একটি রাজনৈতিক দলেরও নেতা। অতএব দেশটির নীতি-নির্ধারণেও রয়েছে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ধারণ করেন উল্লেখযোগ্য মাত্রার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক হার্ড পাওয়ার (সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব খাটানোর ক্ষমতা) এবং সফট পাওয়ার (কোনো বলপ্রয়োগ না করেই অন্য দেশকে নিজের দেশের মতের বা চাওয়া-পাওয়ার পক্ষে আনার ক্ষমতা)। এত ক্ষমতা নিয়ে জো বাইডেন এখন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট। গত ২০ জানুয়ারি তিনি এই দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। তিনি চাইলে বিশ্বের অনেক সমস্যারই ন্যায়ভিত্তিক সমাধান করতে পারেন। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে অধিকতর ন্যায়ানুগ হয়ে ওঠা। বাইডেন তা করতে কতটুকু পারবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ও তার দলের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার সাথে সদ্যবিদায়ী রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার দলের রাজনীতির উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। সে কারণে ট্রাম্পের মতো একরোখা যুদ্ধপ্রেমী ও ইসরাইলপ্রেমী প্রেসিডেন্টের বিদায় ঘটিয়ে জো বাইডেনের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হওয়া নিশ্চিতভাবেই ইসরাইলকে খুশি করেনি। অনেকেই মনে করছেন, ইসরাইল ট্রাম্পের কাছ থেকে যে চরম ফিলিস্তিনবিরোধী সমর্থন অব্যাহতভাবে পেয়ে আসছিল, তার আপাত ছেদ ঘটবে বাইডেনে আমলে। অনেকেরই বিশ্বাস, জো বাইডেন আর যা-ই করুন, ফিলিস্তিন প্রশ্নে অন্তত একটি স্থিতাবস্থা বজায় রাখবেন।’ কার্যত তেমনটিই ঘটবে বলে মনে হয়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট তথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে বাস্তবায়ন করেন স্বদেশের বিদেশনীতি। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ট্রেজারি সেক্রেটারি, ডিফেন্স সেক্রেটারি ও অ্যাটর্নি জেনারেল বিবেচিত হন মন্ত্রিপরিষদের চার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে; তাদের নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বের কারণেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মনোনয়ন দেন প্রেসিডেন্ট। এরপর পররাষ্ট্র নীতিসম্পর্কিত কনফারমেশন হিয়ারিং শেষে সে দেশের সিনেট তার নিয়োগ নিশ্চিত করে। জো বাইডেন এরই মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে। সিনেটের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তার নিয়োগ নিশ্চিত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। ব্যতিক্রমী কিছু না ঘটলে তিনিই হতে যাচ্ছেন বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
অনেকেই মনে করছেন- অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বিল ক্লিন্টন ও ওবামার প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতিই অব্যাহত রাখবেন। ব্লিঙ্কেনের বাবা ও চাচা ক্লিন্টন প্রশাসনের সময় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর তার ‘বৈ-পিতা’ কাজ করেছেন জন এফ কেনেডি প্রশাসনে। তাকে বিবেচনা করা হয় মাল্টিল্যাটারেলিস্ট ও ইন্টারন্যাশনালিস্ট হিসেবে, যিনি ইউরোপীয় মিত্রদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখায় বিশ্বাসী। তিনি ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি সমর্থন করেন। তবে তিনি ইসরাইলের একজন সমর্থকও। অতএব প্রশ্ন আসে- জো বাইডেনের আমলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরাইলের সাথে আমেরিকার সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে? ট্রাম্পের অধিকতর জটিল করে তোলা ফিলিস্তিন সমস্যা প্রশ্নে বাইডেন প্রশাসনের অবস্থান কী হবে? এদিকে বাইডেন প্রশাসনকে মোকাবেলা করতে হবে ট্রাম্প প্রশাসনের রেখে যাওয়া কোভিড-সম্পর্কিত ব্যাপক জনস্বাস্থ্য সঙ্কটসহ নানা অভ্যন্তরীণ সমস্যা। এ ছাড়াও আছে ট্রাম্পের এলোমেলো করে রেখে যাওয়া চীনের সম্প্রসারণবাদনীতি-সংশ্লিষ্ট সমস্যা, ইউরোপে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ সম্পর্কিত জটিল সমস্যা এবং ইরানের সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন করে সৃষ্টি করা বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলার মতো কাজ। তাই এতসব আশু করণীয় সমস্যা মোকাবেলা করে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে বাইডেন কতটুকু মনোযোগী হতে পারবেন? সে বিষয়ে আছে সংশয়। তবে আশা করা যেতে পারে, তিনি হয়তো ফিলিস্তিন-সম্পর্কিত কিছু ক্ষতিকর পদক্ষেপ পাল্টে দিতে পারেন। যেমন : তিনি ওয়াশিংটনে পুনরায় খুলে দিতে পারেন পিএলও অফিস; ফিলিস্তিনিদের সেবাকাজের জন্য পূর্ব জেরুসালেমে খুলতে পারেন মার্কিন কনস্যুলেট অফিস এবং আবার চালু করতে পারেন ট্রাম্পের বন্ধ করে দেয়া ‘ইউনাইটেড ন্যাশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস অ্যাজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস’ (ইউএনআরডব্লিউএ)-এর তহবিল সরবরাহ। কিন্তু বাইডেন জেরুসালেম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিবে ফিরিয়ে যে নেবেন না, সে ব্যাপারটি তিনি নির্বাচনের আগেই স্পষ্ট করেছেন। বাইডেনের মনোনীত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনও একইভাবে বলেছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ রাজনৈতিকভাবে বাস্তবসম্মত হবে না। তা ছাড়া তিনি মনে করেন, সমঝোতা প্রশ্নে ফিলিস্তিনিদের ব্যর্থতা রয়েছে। তার মতে, ফিলিস্তিনিদের এমন নেতৃত্ব দরকার, যারা ইহুদি রাষ্ট্রের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সক্ষম। তা ছাড়া নির্বাচনের আগে বাইডেন সুস্পষ্টভাবে ইসরাইলবিরোধী ‘বয়কট, বিনিয়োগ প্রত্যাহার, নিষেধাজ্ঞা আন্দোলন’ (বিডিএস) প্রত্যাখ্যান করেন। এর বাইরে, ইরান-সম্পর্কিত ট্রাম্পের নীতির বিপরীত কিছু করতে গেলেই মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের সাথে বাইডেনের মতবিরোধ দেখা দেবে। তা ছাড়া, ইসরাইল এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, বাইডেন ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি বহাল করলে ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। অতএব এটুকু স্পষ্ট, ট্রাম্প-উত্তর বাইডেন ফিলিস্তিনিদের জন্য বড় কিছু করবেন- এমনটি দুরাশা মাত্র। বড়জোর একটা স্থিতাবস্থা ফিলিস্তিনিরা কামনা করতে পারেন।
ইতিহাসের ধারাটিও ফিলিস্তিনের বিপরীতে। দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনপুষ্ট ইসরাইলের উপনিবেশবাদী দখলদারিত্বে ফিলিস্তিনিরা অব্যাহত চরম দুর্ভোগের শিকার। এ কাজে যুক্তরাষ্ট্র বরাবর ইসরাইলকে জুগিয়ে আসছে রাজনৈতিক, আর্থনীতিক ও সামরিক সমর্থন। এর ফলে ইসরাইল ফিলিস্তিনে ক্রমেই উপনিবেশ তথা দখলদারিত্ব সম্প্রসারণে সক্ষম হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের মাত্র ৫ শতাংশ জায়গা ফিলিস্তিনিরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। এই প্রক্রিয়ায় কার্যত কোনো আন্তর্জাতিক বাধার মুখে কখনোই পড়তে হয়নি ইসরাইলকে। সেখানে স্বঘোষিত মধ্যস্থতাকারী ওয়াশিংটন কথিত ‘শান্তি পরিকল্পনা’র নামে নানা কৌশলী প্রক্রিয়ায় বরাবর ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা ও এর ইচ্ছা বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে।
২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কৌশলে ফিলিস্তিনে ইসরাইলের উপনিবেশায়নকেই সম্প্রসারিত করার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। তিনি আন্তরিকভাবে কাজ করে গেছেন ইসরাইলের বর্ণবাদী ও চরম সন্ত্রাসী অ্যাজেন্ডা নীতি বাস্তবায়নের পক্ষে। অপর দিকে, ফিলিস্তিনিদের অধিকার সংরক্ষণ ও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উচ্চারণ করেছেন মিষ্টি মিষ্টি কথা। ইসরাইলের ডানপন্থী সরকার যা চেয়েছে, তাই করতে দিয়েছেন ও জুগিয়েছেন সক্রিয় সহায়তা- নীতিসহায়তা থেকে শুরু করে ফিলিস্তিনবিরোধী নানা পদক্ষেপে ইসরাইলকে প্ররোচিত করাসহ অব্যাহত সামরিক সহায়তা দিয়েছেন। ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বেআইনি ও অবৈধ কর্মকাণ্ডকে দিয়েছেন বৈধতা। এর ফলে ফিলিস্তিনিদের অধিকার বাস্তবায়নের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক ও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
ট্রাম্পের চার বছরের শাসনামলে ইসরাইল কার্যত ফিলিস্তিনবিরোধী তৎপরতা আরো জোরদার করেছে ট্রাম্প প্রশাসনের সক্রিয় সহায়তায়। ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি বিল পাস করেছিল। মার্কিন প্রশাসন দুই দশকেরও বেশি সময়েও তা কার্যকর করেনি। কিন্তু ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশ জারি করে এই আইন বাস্তবায়ন করেন তেল আবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস জেরুসালেমে স্থানান্তরে। পরের বছর ১৪ মের ‘নাকবা দিবসে’ তা কার্যকর করা হয়।
এর কয়েক মাস পর ট্রাম্প ঘোষণা দেন ‘ইউনাইটেড ন্যাশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস অ্যাজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস’ প্রত্যাহার করে নেয়ার। এটি ছিল লাখ লাখ ফিলিস্তিনির জন্য রীতিমতো একটি আকস্মিক বিপত্তি। কারণ- তারা খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের সংস্থাগুলোর তহবিলের ওপর নির্ভরশীল। আসলে এটি ছিল শরণার্থী হিসেবে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি মর্যাদাহানিকর পদক্ষেপ। সেই সাথে ট্রাম্প প্রশাসন তৎপর ছিল, যাতে ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরে এসে তাদের মাতৃভূমির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারে; ঠেকাতে না পারে জাতিগত নিধন। তাদের দেশে ফিরে আসার অধিকার বাধাগ্রস্ত করা হয় ট্রাম্পের ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’র মাধ্যমে, যা তার জামাতা কুশেনার সামনে নিয়ে আসেন। এই ডিলে আগের ‘শান্তি উদ্যোগের’ ভাষার আদলে প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করা হয় ফিলিস্তিনিদের ‘শান্তি’ ও ‘সমৃদ্ধি’র। কিন্তু অস্বীকার করা হলো তাদের বেশির ভাগ দাবি। বিশেষ করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের মৌল দাবিটি এই ডিলে অস্বীকার করা হয়েছে।
ট্রাম্প আমলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর ঘোষণা দেন : যুক্তরাষ্ট্র বিবেচনা করে দেখবে পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বসতি নির্মাণে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না। ট্রাম্প প্রশাসনের সর্বশেষ মাসটিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরাইলকে আরেকটি বড় ধরনের পুরস্কার দিয়ে যেতে ভুল করেননি। সেটি হচ্ছে, ইসরাইলের সাথে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ করার পদক্ষেপ। সেটি ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের প্রতি আরেকটি বড় ধরনের আঘাত।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদার পর আরব লিগ সৌদি আরবের মরহুম বাদশাহ আবদুল্লাহর উদ্যোগে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিছু শর্তসাপেক্ষে। শর্তগুলো ছিল : ১৯৬৭ সালের সীমান্ত অনুযায়ী ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করতে হবে; শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনতে হবে এবং গোলান উপত্যকা থেকে ইসরাইলি বাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে।
গত বছর আগস্টে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ট্রাম্প প্রশাসনের প্ররোচনায় সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তি করে ইসরাইলের সাথে। এসব চুক্তিতে দেশ দুটি এসব শর্ত বেমালুম ভুলে যায় এবং স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে কোনো দাবি তোলেনি। এর অল্প সময় পরে মরক্কো ও সুদান ইসরাইলের সাথে একই ধরনের চুক্তি করেছে। এটি ‘শান্তির বিনিময়ে ভূমি’ সম্পর্কিত ঐকমত্যের সম্পূর্ণ বিচ্যুতি।
এমনি প্রেক্ষাপটে আমেরিকায় ক্ষমতায় এলেন জো বাইডেন। এর ফলে অনেক ফিলিস্তিনির মাঝে নতুন আশার জন্ম নিয়েছে। তাদের প্রত্যাশা, এবার ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসনের নীতিগত অবস্থানে একটা পরিবর্তন আসবে। আসলে ট্রাম্প প্রশাসনের ফিলিস্তিন নীতি ওয়াশিংটনের প্রচলিত নীতি ও অবস্থান থেকে আলাদা ছিল না। ওয়াশিংটনের বরাবরের ফিলিস্তিন নীতি হচ্ছে : ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতি নিঃশর্ত ও পরিপূর্ণ সমর্থন দান। অতএব বাইডেন প্রশাসন তার পূর্বসূরিদের এই নীতি অবস্থান থেকে সরে এসে ফিলিস্তিনিদের সহায়ক ভিন্ন ধরনের নীতি চর্চা করবেন, তেমনটি আশা করা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। আসলে জো বাইডেনের টিম নানাভাবে এটি স্পষ্ট করেছে, তার টিম ট্রাম্পের কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে না। এমনকি তেল আবিব থেকে জেরুসালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সরিয়ে আনার সিদ্ধান্তটাও পাল্টানো হবে না। তার প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকারের আন্দোলনও সমর্থন করবে না; সমর্থন করবে না ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা আন্দোলন, চাইবে না ফিলিস্তিন দখলের অবসান, চাইবে না ইসরাইলের বর্ণবাদী সরকারের পতন কিংবা চাইবে না ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা ফিরে আসুক নিজেদের মাতৃভূমিতে।
ফিলিস্তিনিদের জানা ও শেখা উচিত, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রশাসনই ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে সত্যিকারের মধ্যস্থতাকারী হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি প্রশাসন ফিলিস্তিনে ইসরাইলের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক সহযোগিতা অতীতে জুগিয়েছে। ভবিষ্যতে এই দখলদারিত্ব বজায় রাখা কিংবা আরো জোরদার করায় ইসরাইলকে সহযোগিতা জুগিয়ে যাবে। ঠিক ট্রাম্প প্রশাসনের মতোই বাইডেন প্রশাসনও ইসরাইলকে সবকিছুই দিবে, যা চাইবে ইসরাইল। এই চাওয়া বৈধ কি অবৈধ, মানবিক না অমানবিক, যৌক্তিক না অযৌক্তিক- সে প্রশ্ন তুলবে না ওয়াশিংটন। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র জোগাতে যুক্তরাষ্ট্র পিছপা হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের পরিপূর্ণ সমর্থন নিয়েই ইসরাইল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে অসম্ভব করে তুলবে। তবে একটি সত্য ইসরাইলের জেনে রাখা উচিত- ইসরাইলের পর্যাপ্ত সামরিক শক্তিমত্তা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং একটি পরাশক্তির সীমাহীন সর্মথন থাকা সত্ত্বেও ইসরাইল কখনোই পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা পাবে না, নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে। ষাট লাখ ফিলিস্তিনি তাদের স্বাধীনতা ও মাতৃভূমি হারিয়ে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনে আজো টিকে আছে। আরো লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বসবাস করছে আশপাশের আরব দেশগুলো ও ‘ডায়াসপোরা’য়। তাদের জাতিসত্তা ও অস্তিত্ব বিলোপ করে বর্ণবাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ইসরাইলের একমাত্র লক্ষ্য। ওরা আবার ইসরাইলকে অভিহিত করে বিশ্বের একটি ‘মডেল ডেমোক্র্যাসি’ নামে। আর এ ক্ষেত্রে ইসরাইলের বরাবরের সাথী যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশ। এই লজ্জা যেমনি ইসরাইলের,তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের কাছে শুধু ফিলিস্তিনিরা নয়, বিশ্বের তাবৎ বিবেকবান মানুষের প্রত্যাশা এর বিপরীত কিছু।

Source : Jugantar 

সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০২০

ফ্রা‌ন্সের পণ্য বয়কট প্রসং‌গে

       ‌বি‌শ্বের, মুস‌লিম বি‌শ্বের এবং ফ্রা‌ন্সের শা‌ন্তির জন্য ফ্রা‌ন্সের ভাবা উ‌চিৎ । হয় তো মুস‌লি‌মের মে‌রে ফ্রান্স য‌থেষ্ট কর‌তে পার‌বে কিন্তু ফ্রা‌ন্সের এবং সমগ্র বি‌শ্বের কি কিছুই ক্ষ‌তি হ‌বে না ? সে কার‌নেই  বল‌ছি তা‌দের তথা বি‌শ্বের ভাবা দরকার যে , বাক স্বাধীনতা মা‌নে কারও ধর্ম  বিশ্বা‌সে আঘাত করা নয় । অথচ বলা হয়  ফ্রান্স গনতন্ত্রের দেশ ।এ সমস্যার সমাধানের জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।ফ্রা‌ন্সের পণ্য বয়ক‌টের রেশ বাংলা‌দে‌শেও ছ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে‌ছে ।  মুসলমানেরা আশা করেন আমা‌দের নবী সঃ কে  যেন  অপমান না করা হয়।

বাংলাদে‌শেও পণ্য বয়ক‌টের প্রচারপত্র :

‌জো বাই‌ডে‌নের সম্পদ

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত জো বাইডেনের সম্পদ নিয়ে জল্পনা-কল্পনাও শুরু হয়ে গেছে। 
 নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালের স্টেট এবং ফেডারেল আয়কর রিটার্নের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে তার বরাত দিয়ে ফোর্বস গত বছর এক প্রতিবেদনে জানায়, বাইডেনের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৯০ লাখ ডলার (৭৬ কোটি ২৩ লাখের বেশি টাকা)।  
১৯৭৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সিনেটর ছিলেন বাইডেন। সিনেটের হিস্টোরিক্যাল রেকর্ড বলছে, এই সময়ের মধ্যে ‌জো বাইডেনের বেতন ৪২ হাজার ৫০০ ডলার থেকে প্রতি বছর ১ লাখ ৭৪ হাজার ডলার পর্যন্ত হয়েছে। জো বাইডেন তখন উপহাস করে বলতেন, আমি কংগ্রেসের সবচেয়ে গরীব মানুষ। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন জো বাইডেন। তখন এক ধাক্কায় তার বেতন ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। প্রতি বছরে সেই বেতন দাঁড়ায় প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার ডলারে। ২০১৯ সালে বাইডেন জানিয়েছিলেন, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে তার এবং স্ত্রী জিল বাইডেনের সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৫ লাখ ডলার। 

সূত্র: টাউন অ্যান্ড কাউন্টি

Source: Bangladesh Protidin

বৃহস্পতিবার, ৫ নভেম্বর, ২০২০

আ‌মে‌রিকার নির্বাচ‌নে কয়েকটি রা‌জ্যে ভোট ব্যবধান

আলাস্কা ও নর্থ ক্যারোলাইনার ভোট গণনার হালনাগাদ তথ্য আগামী সপ্তাহের আগে পাওয়া সম্ভব হবে না। 
অ্যারিজোনা 
রাজ্যটির ম্যারিকোপা ও পিমা কাউন্টিতে নতুনভাবে ভোট গণনায় সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে আছেন বাইডেন। তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে ৪৬ হাজার থেকে ৪৯ হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছেন।
জর্জিয়া
 ডোনাল্ড ট্রাম্প এই রাজ্যটিতে এগিয়ে আছেন । দিনের শুরুতে ১৮ হাজার ভোটে এগিয়ে থাকলেও এখন বাইডেনের চেয়ে মাত্র দুই হাজার ভোটে এগিয়ে তিনি।
নেভাদা 
রাজ্যটিতে ভোটের ব্যবধান কমিয়ে আনার প্রত্যাশা ছিল ট্রাম্পের। কিন্তু তা আরও বাড়ছে। ব্যবধান আট হাজার থেকে বেড়ে তা ১১ হাজারে পৌঁছেছে।
পেনসিলভেনিয়া
দিনের শুরুতে এক লাখ ৬০ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু সেই ব্যবধান কমে এখন ৩৭ হাজারে পৌঁছাল।

Source : Jugantor

বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০২০

যুক্তরাষ্ট্রের ভোটে আমাদের কোনো সমস্যা নেই

 

   ড.মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যে কেউ ক্ষমতায় আসুক না কেন, আমাদের কোনো সমস্যা নেই।জো বাইডেনের জেতার পথে ,ট্রাম্প বলছেন ভোট জালিয়াতি  হয়েছে।পররাষ্ট্র নীতি কোনো ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে না উল্লেখ করে ড. মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যে কেউ ক্ষমতায় আসুক না কেন, আমাদের কোনো সমস্যা নেই।    তারা প্রতিটি রাজ্যের মর্যাদা ধরে রেখে খুব সুন্দরভাবে ব্যবস্থাটি তৈরি করেছে।মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি খুব ভালো করছে এবং বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিকভাবে খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে। আমরা নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছি। কোনো দেশের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা নেই। আমরা সবার মঙ্গল কামনা করি।তার মতে, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ খুব ভালোভাবে কাজ করবে।  তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ সর্বত্র স্থিতিশীলতা দেখতে চায়।  আমরা দৃঢ় স্থিতিশীলতা চাই।

২০১৭ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির কারণে প্রবাসীদের অসুবিধা হলেও টিপিপি তুলে দেয়ায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ড. মোমেন।  তিনি বলেন, ট্রাম্প আসার পরে আমাদের দেশের প্রবাসীদের অনেকের অসুবিধা হয়েছিল।  কিন্তু আমাদের দেশের বড় উপকার হল উনি (ট্রাম্প) এসে টিপিপিটা বাদ দিয়ে দিলেন।  আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো বিনা ট্যারিফে আমেরিকায় জিনিস পাঠাত, এগুলো তিনি বাদ দিয়ে দিলেন। তার ফলে আমাদের একটা ভালো সুবিধা হয়।ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, উনি (ট্রাম্প) আসার পর আমাদের সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক ছিল। আমরা সন্ত্রাসমুক্ত হয়েছি অনেকটা, আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। আমরা উন্নতিও করেছি। আমরা কারও ওপর নির্ভরশীল না। 

ইনশা আল্লাহ।




 

বুধবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২০

সেকুলারদের কথা ফ্রান্স হচ্ছে গণতন্ত্র এর দেশ

 দুনিয়াব্যাপী সেকুলারদের একটা বয়ান হচ্ছে ফ্রান্স হচ্ছে গণতন্ত্র এবং লিবার্টি বা স্বাধীনতার ধারক-বাহক।
ফ্রান্স টিকেই আছে আফ্রিকাকে শোষণ করার মধ্য দিয়ে। এটা গোপন কিছু না। সময়ে সময়ে ফরাসিরা নিজেরাও এটা স্বীকার করে। ১৯৫৭ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেঁরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, আফ্রিকার উপর নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখতে না পারলে একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে ফ্রান্সের কোনো জায়গা থাকবে না।

পাঁচ দশক পর তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক ২০০৮ সালে সেটা আবারও নিশ্চিত করে বলেছিলেন, আফ্রিকা না থাকলে ফ্রান্স তৃতীয় বিশ্বের তালিকায় ছিটকে পড়ত। তিনি পরিষ্কারভাবেই স্বীকার করেছিলেন, ফ্রান্সের ব্যাঙ্কগুলোতে যে টাকা আছে, তার একটা বড় অংশ আসে আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোকে শোষণ করার মধ্য দিয়ে।

কীভাবে ফ্রান্স আফ্রিকাকে শোষণ করছে? প্রধানত কলোনিয়াল মুদ্রা সিএফএ ফ্রাঙ্কের (CFA Franc – Franc of the French Colonies in Africa) মাধ্যমে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন আফ্রিকাজুড়ে কলোনিগুলো স্বাধীনতা দাবি করে, তখন ব্রিটিশ, স্প্যানিয়ার্ড এবং ইতালিয়ানরা তুলনামূলকভাবে সহজেই তাদেরকে স্বাধীনতা দিয়ে ফিরে যায়। কিন্তু ফ্রান্স ছিল ব্যতিক্রম। তারা তাদের কলোনিগুলোকে স্বাধীনতা দেয় এই শর্তে যে, স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোকে তারা অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে সহযোগিতাকরবে।

সামরিক ক্ষেত্রে এই সহযোগিতার অর্থ ছিল, ফরাসি সেনাবাহিনী স্বাধীনতার পরেও আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোতে অবস্থান করবে, তাদের পুলিশ এবং সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিবে, বিনিময়ে রাষ্ট্রগুলোকে তাদের সকল অস্ত্র ক্রয় করতে হবে কেবলমাত্র ফ্রান্সের কাছ থেকে।

আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই সহযোগিতার অর্থ ছিল, স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোকে তাদের মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করতে হবে সিএফএ ফ্রাঙ্ক। শুধু তাই না, রাষ্ট্রগুলোর যেকোনো প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের ক্ষেত্রে, যেকোনো বড় প্রজেক্ট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আগে ফ্রান্সকে প্রস্তাব দিতে হবে।

সিএফএ ফ্রাঙ্ক মুদ্রাটি নিয়ন্ত্রণ করে ফ্রেঞ্চ ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট। আর সে কারণে আফ্রিকায় ফ্রান্সের ১৪টি সাবেক কলোনিকে আজও তাদের ফরেন রিজার্ভের অর্ধেক (আগে ছিল ৬৫%, তারও আগে ৮৫%) জমা রাখতে হয় ফ্রেঞ্চ ট্রেজারির কাছে।

দেশ চালানোর জন্য তাদের যদি অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হয়, তাহলে তাদেরকে সেটা ঋণ নিতে হয় ফ্রান্সের কাছ থেকেই। এবং সেই ঋণের সুদ শোধ করতে করতেই তাদের বাকি জীবন অতিবাহিত হয়। চক্রে আটকা পড়ে যায় তাদের জীবন।

ভাবতে পারেন, আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলো কেন এই ব্যবস্থা মেনে নিচ্ছে? কেন তারা এই সিস্টেম থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে না? উত্তরটা হচ্ছে, অনেকেই চেষ্টা করেছিল। তাদের পরিণতি ভালো হয়নি।

স্বাধীনতার পর সেকু তুরের নেতৃত্বে গিনি ফ্রান্সের আধিপত্য মেনে নিতে রাজি হয়নি। ১৯৬০ সালে তারা ফ্রাঙ্ক জোন ছেড়ে বেরিয়ে যায়। প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ফ্রেঞ্চ সিক্রেট সার্ভিস জাল মুদ্রা সরবরাহ করে গিনির অর্থনীতি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়।

সিলভানাস অলিম্পিওর নেতৃত্তে টোগোও স্বাধীনভাবে পথ চলার উদ্যোগ নেয়। স্বতন্ত্র টোগোলিজ মুদ্রা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৬৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। পরের দিন সকালে ফরাসিদের দ্বারা প্রশিক্ষিত টোগোলিজ সেনারা অলিম্পিওকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে।

এটা ছিল সাবেক কলোনিগুলোতে সংঘটিত ফ্রান্সের প্রথম ক্যু, পরবর্তীতে যার পুনরাবৃত্তি হয়েছে অনেকবার।

আফ্রিকার প্রতিটি সাবেক কলোনিতে ক্যু এবং পাল্টা ক্যুয়ের মাধ্যমে ফ্রান্স নিজেদের অনুগত স্বৈরশাসকদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে রেখেছে, আর তাদের মাধ্যমে খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ আফ্রিকার সম্পত্তি লুট করে যাচ্ছে।

১৯৬৪ সালে ফ্রান্স গ্যাবনে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ওমার বঙ্গোকে ক্ষমতায় বসায়, যার শাসনব্যবস্থা চলে পরবর্তী ৪২ বছর পর্যন্ত। গ্যাবনের গুরুত্ব কী? গ্যাবনে আছে বিশাল ইউরেনিয়ামের মজুদ। আর ফ্রান্সের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরগুলোর জন্য দরকার এই ইউরেনিয়াম।

ওমারের মৃত্যুর পর আজও গ্যাবনের ক্ষমতায় আছে তার ছেলে আলি ওমার বঙ্গো। ফ্রান্সের প্রতি তাদের আনুগত্যের বিষয়টা প্রকাশ পায় ওমার বাঙ্গোর একটা উক্তি থেকে। যেখানে জ্যাক শিরাক নিজেই আফ্রিকাকে শোষণের কথা স্বীকার করেছিলেন, সেখানে বাঙ্গো বলেছিলেন, গ্যাবনকে ছাড়া ফ্রান্স হচ্ছে ড্রাইভার ছাড়া গাড়ির মতো, আর ফ্রান্সকে ছাড়া গ্যাবন হচ্ছে জ্বালানী ছাড়া গাড়ির মতো।
অথচ বাস্তবে ফ্রান্সই দশকের পর দশক ধরে গ্যাবনের কাছ থেকে ইউরেনিয়াম জ্বালানি আদায় করে নিচ্ছে অত্যন্ত সুলভ মূল্যে।

এই সুলভ মূল্যে যদি কেউ রাজি না হয়, তাহলে তার ভাগ্যেও জুটতে পারে অভ্যুত্থান। সেটাই ঘটেছিল নাইজারের প্রেসিডেন্ট মামাদু তানজার ভাগ্যে। ফ্রান্সের দেওয়া মূল্য কম মনে হওয়ায় ২০০৯ সালে তিনি ইউরেনিয়ামের মূল্যের ব্যাপারে চীনের সাথে দরদাম শুরু করেছিলেন। কয়েক মাসের মধ্যেই তাকে বিদায় নিতে হয়।

২০১১ সালে বিদায় নিতে হয় আইভরি কোস্টের প্রেসিডেন্টকেও। সেখানেও একই কারণ। তবে ইউরেনিয়াম না, আইভরি কোস্ট হচ্ছে ফ্রান্সের প্রধান কফি এবং কোকো সরবরাহকারী রাষ্ট্র।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ফ্রান্স এ পর্যন্ত ৩০টিরও বেশি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। আফ্রিকার প্রায় প্রতিটা অভ্যুত্থান, প্রতিটা গুপ্তহত্যার পেছনে ফ্রান্সের কোনো না কোনো ভূমিকা আছে।

এবং এটা শুধু মধ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না। ২০১১ সালে গাদ্দাফিকে উৎখাত করার পেছনেও প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল ফ্রান্স। সে সময় আমেরিকার ভূমিকা ছিল লিডিং ফ্রম বিহান্ড। ওবামা প্রশাসন ছিল দ্বিধাবিভক্ত। কিন্তু ফ্রান্স একেবারেই শুরু থেকেই ছিল আগ্রাসী।

ফ্রান্সই সর্বপ্রথম লিবিয়ার বিদ্রোহীদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ফ্রান্সই জাতিসংঘের রেজোল্যুশন ড্রাফট করেছিল। এবং সেই রেজোল্যুশন পাশ হওয়ার আগেই ফ্রান্স তার যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে দিয়েছিল বেনগাজির দিকে অগ্রসর হতে থাকা গাদ্দাফির বাহিনীর উপর হামলা করার জন্য।

গাদ্দাফির মৃত্যুর পরে আমেরিকা লিবিয়া থেকে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ফ্রান্স দিনে দিনে তার ইনভলভমেন্ট আরো বৃদ্ধি করেছে। আমেরিকার অক্সিডেন্টাল অয়েল অ্যান্ড গ্যাস লিবিয়া ছেড়ে যাওয়ার সময় নিজেদের শেয়ার বিক্রি গেছে ফ্রান্সের টোটালের কাছে।

কিন্তু এটা ঘটেছে বৈধভাবে। আর অবৈধভাবে ফ্রান্স লিবিয়ার দক্ষিণে স্বর্ণের খনি থেকে স্বর্ণ উত্তোলন এবং চোরাচালান করে নিয়ে যাচ্ছে কোনো নজরদারি ছাড়াই। প্রায় কোনো মিডিয়াতেই এটা পাওয়া যায় না, কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের স্থানীয় লিবিয়ানদের কাছ থেকে শোনা যায়, সেখানে আফ্রিকানদেরকে দিয়ে স্বর্ণ উত্তোলন করানোর এই কার্যক্রমের পেছনে ফরাসি কোম্পানিগুলোই দায়ী।

 Live: Paris' Eiffel Tower reopens to public - CGTN


উৎসঃ ইসলামিক অনলাইন মিডিয়া